পলাশীর পরাজয়ের পর হইতে এই বাংলাদেশে কত বিদ্রোহ হইয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। তজ্জন্য বাংলার মানুষ বহু নির্যাতন ভোগ করিয়াছে। কিন্তু পরিণামে বুঝা গেল, যেহেতু জাতীয় চরিত্র গঠিত হয় নাই, তাই কাজের কাজও কিছুই হয় নাই।
আমরা বলিয়া থাকি, মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠিলে সকল সমস্যার সমাধাণ হইবে। কিন্তু মানুষ কি করিয়া মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠিবে তাহার পথ দেখাইয়া দিই না। খাইয়া পরিয়া স্বাস্থ্য ভাল হইতে পারে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি ব্যতীত চরিত্র গঠন হইবে না। সাময়িক ভাবোন্মাদনায় যে উন্নত চরিত্র ফুটিয়া উঠে তাহা জোয়ার-ভাটা মাত্র। যে জাতি কেবলি কল্যাণের দিকে গতিশীল, তাহাই আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ বাছিয়া লয়। যখন জাতীয় চরিত্র রাব্বুল আলামিনের রবুবিয়াত বা প্রতিপালনের বিধি-বিধানের সন্ধান লাভ করে, তখন হইতেই সুখ ও শান্তির পথে দেশ এবং জাতি গঠিত হইতে থাকে। তাই মানুষকে প্রথমে সব কিছুর মূলের দিকে এবং সামঞ্জস্যমন্ডিত সকল বিধান প্রতিবিধানের প্রতি নজর দিতে হইবে।
সবাই বলে ‘আমি যদি ক্ষমতায় যাই তবে ইহার চাইতে ভাল করিব’। কিন্তু, ইংরেজ তাড়াইয়া মানুষ সুখে আছে বলে নাই। পাঞ্জাবী হটাইয়া সুখ তো দূরের কথা দুখের পর দুখ আসিতেছে। যে পার্টি বলিত ‘আমরাই ভাল করিবার পাত্র’, তাহাদিগকে পাইয়া মানুষ বুঝিয়াছে ‘আমি’ এবং ‘আমাদের’ দাবীদার হইলেই মানুষের সুখ শান্তি ফিরাইয়া আনিবার উপযুক্ততা থাকে না। ...
মানুষের সেবা তথা সৃষ্টি মাত্রেরই কল্যাণ করিতে ‘আমি’ এবং ‘আমরা’ বলিবার কোন অবকাশ নাই। .. ‘আমরা’ এবং ‘আমাদের’ কল্যাণ করিব কি জন্য? উদ্দেশ্য কি থাকিবে?
উদ্দেশ্য থাকিবে ‘হক্কুল এবাদ’ কায়েম। ‘হক্কুল্লাহ’ আদায় না হইলে খালেস নিয়তে তওবা করিলে আল্লাহ মাফ করিয়া দেন। কিন্তু ‘হক্কুল এবাদ’-এর খেলাফ হইলে আল্লাহ মাফ দেন না।
সাবেক পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্ব শাসন দেওয়া ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের ‘হক্কুল এবাদ’ আদায়ের নামান্তর। কেন্দ্র তাহা করে নাই; আল্লাহর বিধানও তাহা চিরকালের জন্য বরদাশত করে নাই।
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কোন দেশের প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষাগত, ধর্মীয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে বান্দার হক বুঝাইয়া দেওয়াই হইল ‘হুকুমতে রব্বানীয়া’-র প্রথম শর্ত। তজ্জন্য সামাজিক সাম্য, অর্থনৈতিক প্রয়োজনভিত্তিক বন্টন, তামাদ্দুনিক উৎকর্ষতা ইত্যাদী অপরিহার্য। মোট কথা, সকল ক্ষেত্রে বান্দার স্বাভাবিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক বুঝাইয়া দাও, তাহার অধিকারের আমানত বিন্দুমাত্র খেয়ানত করিও না। ...
আজ বাংলাদেশের অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে, তাহারা ‘হুকুমতে রব্বানিয়া’-কে ‘হনুজ দূর আস্ত’ মনে করে। ... তবে হতাশ হইবার কিছু নাই। আমাদের কাছে ‘রবুবিয়াত’-এর আদর্শ আমানত স্বরূপ রহিয়াছে। উহার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাই সমস্যার সমাধান করিয়া দিবে, ইনশাল্লাহ। ...
[বইয়ের নাম “রবুবিয়াত – মওলানা ভাসানীর শেষ কথা”। সংকলক – সৈয়দ ইরফানুল বারী। প্রথম প্রকাশ অক্টোবর ২০০২। পরিবেশক – খন্দকার প্রকাশনী, জাতীয় সাহিত্য সৃজনী সংস্থা, এতিম খানা রোড, টাংগাইল।]