উপসম্পাদকীয়
‘সুন্নাহর সান্নিধ্যে’
অসাধারণ একটি গ্রন্থ
শাহ্ আব্দুল হান্নান
০৬ মার্চ ২০১৫,শুক্রবার, ২০:৪৯
শাহ্ আব্দুল হান্নান
০৬ মার্চ ২০১৫,শুক্রবার, ২০:৪৯
ইসলামি আইনের উৎস সুন্নাহ বা হাদিস সম্পর্কে বহু দিন থেকে পড়াশোনা করছি। কারণ সুন্নাহর উপলব্ধি মুসলিম ব্যক্তি ও জাতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে ড. ইউসুফ আল কারজাবির সুন্নাহর ওপর আরবি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ 'Approaching the Sunnah : Comprehension and Controversy' নেই। বইটি পড়ে আমার মনে হলো, সুন্নাহ বা হাদিস সম্পর্কে প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর এ বইতে আছে। এখন এ বইয়ের বাংলা অনুবাদ ‘সুন্নাহর সান্নিধ্যে’ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (BIIT) উত্তরা, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের ইমেইল নম্বর biit_or@yahoo.com।
বইটির গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো তুলে ধরছি। বইটির তিনটি অধ্যায়।
প্রথম অধ্যায়ে তিনি সুন্নাহর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেছেন।
ড. কারজাবির মতে, সুন্নাহর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে
১. এটা একটি সুবিস্তৃত নমুনা। এতে জীবনের সব দিকের জন্যই হেদায়েত রয়েছে।
২. এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি।
৩. কুরআনের ব্যাখ্যা।
৪. সুন্নাহ একটি বাস্তব প্রয়োগযোগ্য পদ্ধতি উপস্থাপন করে।
৫. সুন্নাহ একটি সহজ পথ। সুন্নাহর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জীবনকে সহজ করা, কঠিন না করা। কুরআনের সূরা আরাফের ১৫৭ আয়াতে বলা হয়েছে, রাসূল সা: তাদের (মানবজাতির) পিঠের বোঝা নামিয়ে দেবেন। অর্থাৎ নানা ধরনের রীতি রেওয়াজ ও সামাজিকতার বোঝা বাদ দিয়ে দেবেন এবং যেসব শিকল দ্বারা তারা আবদ্ধ, তা কেটে দেবেন (অর্থাৎ অতিরিক্ত আইন কানুনের বোঝা কমিয়ে দেবেন)। রাসূল সা: সুন্নাহ দ্বারা তাই নিশ্চিত করেছেন।
এরপর তিনি তিনটি বিষয় সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেনঃ-
১. চরমপন্থীদের কর্তৃক সুন্নাহর বিকৃতি।
২. জাল হাদিস অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা এবং
৩. মূর্খদের প্রদত্ত ব্যাখ্যা (দ্রষ্টব্য পৃ-১২-১৫)।
তিনি একই সাথে সুন্নাহর প্রমাণের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা অবলম্বন করতে বলেছেন। নেক কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য হাদিস জাল করা যায়, এ মত তিনি শক্তভাবে খণ্ডন করেছেন (পৃ. ২৪-২৭)।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি আইন ও প্রচারের উৎস হিসেবে সুন্নাহর বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সব আইনবিদই সুন্নাহকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি প্রথম অধ্যায়ে সুন্নাহর বিরুদ্ধে অতীত ও বর্তমানকালে যারা যুক্তি দিয়েছেন, তাদের যুক্তি খণ্ডন করেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি আরো বলেন, ফিকাহর ইজতিহাদভিত্তিক যেসব বিধান রয়েছে, তার মধ্যে পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিলে কেবল ইসলামের শ্রেষ্ঠ আলেমরাই তা করতে পারেন।
তিনি দু’টি উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি মুসলিম-অমুসলিমের রক্তপণ বা রক্তমূল্য (প্রাণের মূল্য) অসমান - এ মত প্রত্যাখ্যান করেন এবং তা সমান - এ মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তেমনিভাবে নারী ও পুরুষের রক্তপণ (প্রাণের মূল্য) এক - এ মতকেই প্রাধান্য দিলেন।
তিনি বলেন, আমাদের জন্য সহিহ ও হাসান হাদিসই যথেষ্ট। জয়িফের কোনো প্রয়োজনই নেই।
তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি সহিহ হাদিস গ্রহণের নীতিমালা বা বোঝার নীতিমালা আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মোট আটটি নীতি দিচ্ছেন।
১. কুরআনের আলোকে বোঝা। কুরআন হচ্ছে ইসলামের হৃদয় এবং ইসলামের সংবিধান। সুন্নাহ্ হচ্ছে তার ভাষ্য। তাই সুন্নাহকে কুরআনের আলোকেই বুঝতে হবে। কুরআন-পরিপন্থী কোনো ব্যাখ্যা করা যাবে না হাদিসের। যদি কোনো সহিহ হাদিসের দু’টি ব্যাখ্যা হয়, তা হলে যে ব্যাখ্যা কুরআনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, সে ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, হাদিস বুঝতে হলে একই বিষয়ের সব সহিহ হাদিসকে একত্রে দেখতে হবে। তা হলে হাদিসের সঠিক তাৎপর্য বোঝা সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি পায়ের গিরার নিচে চলে যায় এমন ইজারসংক্রান্ত হাদিসগুলো একত্র করে মন্তব্য করেন, এ নিষেধাজ্ঞা তাদের জন্যই প্রযোজ্য যারা গর্বের প্রকাশ হিসেবে তা করে, অন্যদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয় (পৃষ্ঠা ১১২-১১৪)।
এ প্রসঙ্গে তিনি আল বুখারির একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যে বাড়িতে লাঙ্গল প্রবেশ করে তা সম্মানহানির কারণ হয়।’ কিন্তু ড. কারজাবি এ-সংক্রান্ত সব সহিহ হাদিস একত্র করে দেখান, এটি কেবল প্রযোজ্য তাদের ক্ষেত্রে যারা জিহাদের সময় নিজের দায়িত্ব পালন না করে কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকে। অন্যান্য হাদিসে কৃষিকাজকে উৎসাহিত করা হয়েছে (পৃ ১১৭-১২০)।
তৃতীয় নীতি হচ্ছে, সহিহ হাদিসে পার্থক্য থাকলে সমন্বয় করতে হবে। সমন্বয় করতে না পারলে কোনো একটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি মহিলাদের কবর জিয়ারতসংক্রান্ত সব সহিহ হাদিস উল্লেখ করেছেন যার অধিকাংশ নারীদের। তেমনিভাবে কবর জিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে, যেমন পুরুষদের। এ হাদিসগুলো অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। তবে নিষেধাজ্ঞাসূচক হাদিসগুলোর সাথে এভাবে সমন্বয়ও করা যায় যে, মহিলারা অতিরিক্ত কবর জিয়ারত করবেন না (পৃ. ১২৩-১২৫)।
হাদিস বোঝার জন্য চতুর্থ মূলনীতি হচ্ছে, হাদিসে উল্লিখিত ঘটনাগুলোর সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলি বিবেচনায় নিতে হবে।
হাদিস বোঝার জন্য পঞ্চম মূলনীতি হচ্ছে, হাদিসের লক্ষ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। উপকরণে পরিবর্তন হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি রাসূল সা:-এর নির্দেশ যে, মক্কার ওজন ও মদিনার পরিমাপকে গ্রহনের উল্লেখ করেন। সে সময় মক্কার ওজন ও মদিনার পরিমাণ সবচেয়ে স্ট্যান্ডার্ড ছিল। সুতরাং হাদিসের লক্ষ্য হচ্ছে ওজন ও পরিমাপ যেন উন্নতমানের হয়। আজকের মিটার মাপ এবং কিলোগ্রাম ওজন গ্রহণ করা ইসলামি নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে তিনি আধুনিককালে যন্ত্রের সাহায্যে চাঁদ দেখার বিষয় আলোচনা করেছেন। রাসূল সা: বলেছেন, চাঁদ দেখে রোজা রাখা এবং রোজা ভাঙা। চাঁদ দেখা না গেলে হিসাব করো। ড. কারজাবি বলেন, সে যুগে চাঁদ দেখার উন্নত যন্ত্রপাতি ছিল না। কিন্তু এখন তা আছে। সুতরাং যন্ত্রের সাহায্যে চাঁদ দেখে রোজা রাখা ও রোজা ভাঙা তিনি অধিকতর সঙ্গত মনে করেন। কারণ এ হিসাব অধিক সঠিক (পৃ. ১৫২-১৬২)।
ড. কারজাবি হাদিস উপলব্ধির জন্য ৬ নম্বর নীতি উল্লেখ করেছেন - আলঙ্কারিক এবং আক্ষরিক অর্থের মধ্যে পার্থক্য করা।
ড. কারজাবি উল্লেখ করছেন, নীল ও ফোরাত নদী জান্নাত থেকে, জান্নাত তরবারির ছায়ার নিচে, মায়ের পায়ের তলে জান্নাত এবং কালো পাথর জান্নাত থেকে - এসব কথাকে রূপক বা আলঙ্কারিক অর্থে গ্রহণ করতে হবে।
হাদিস বোঝার জন্য সপ্তম নীতি হচ্ছে, দৃশ্যমান পৃথিবী এবং অদৃশ্য আখিরাতসংক্রান্ত হাদিসগুলোর পার্থক্য বোঝা।
আখিরাতের বর্ণনা-সংক্রান্ত হাদিসগুলো দুনিয়ার physics বা পদার্থবিদ্যা দ্বারা বোঝা যাবে না। যদি হাদিসটি সহিহ হয়, তবে কেবল পদার্থবিদ্যার আলোকে তা অসম্ভব বলে গ্রহণ না করা অযৌক্তিক হবে। আখিরাতের নিয়মকানুন ভিন্ন হবে।
হাদিস বোঝার জন্য অষ্টম নীতিমালা হচ্ছে, কুরআন ও হাদিসে ব্যবহৃত শব্দগুলো আধুনিককালের অর্থে নয়; বরং কুরআন নাজিল কালের অর্থের আলোকে তা গ্রহণ করতে হবে। যেমনÑ আধুনিক ফটোগ্রাফিকে আগের যুগের তাসবির বলা যাবে না।
হাদিস বোঝার জন্য অষ্টম নীতিমালা হচ্ছে, কুরআন ও হাদিসে ব্যবহৃত শব্দগুলো আধুনিককালের অর্থে নয়; বরং কুরআন নাজিল কালের অর্থের আলোকে তা গ্রহণ করতে হবে। যেমনÑ আধুনিক ফটোগ্রাফিকে আগের যুগের তাসবির বলা যাবে না।
‘সুন্নাহর সান্নিধ্যে’ বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বইটি পড়লে সুন্নাহ বা হাদিস সম্পর্কে আমরা গভীর বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার