Sunday, February 26, 2012

‘হুকুমতে রব্বানী’ প্রসংগে মওলানা ভাসানী (রঃ), ১৫ই এপ্রিল ১৯৭৪ নবাবপুর-ঢাকা


পলাশীর পরাজয়ের পর হইতে এই বাংলাদেশে কত বিদ্রোহ হইয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। তজ্জন্য বাংলার মানুষ বহু নির্যাতন ভোগ করিয়াছে। কিন্তু পরিণামে বুঝা গেল, যেহেতু জাতীয় চরিত্র গঠিত হয় নাই, তাই কাজের কাজও কিছুই হয় নাই।

আমরা বলিয়া থাকি, মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠিলে সকল সমস্যার সমাধাণ হইবে। কিন্তু মানুষ কি করিয়া মানুষ হিসাবে গড়িয়া উঠিবে  তাহার পথ দেখাইয়া দিই না। খাইয়া পরিয়া স্বাস্থ্য ভাল হইতে পারে, কিন্তু আধ্যাত্মিক উন্নতি ব্যতীত চরিত্র গঠন হইবে না। সাময়িক ভাবোন্মাদনায় যে উন্নত চরিত্র ফুটিয়া উঠে তাহা জোয়ার-ভাটা মাত্র। যে জাতি কেবলি কল্যাণের দিকে গতিশীল, তাহাই আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ বাছিয়া লয়। যখন জাতীয় চরিত্র রাব্বুল আলামিনের রবুবিয়াত বা প্রতিপালনের বিধি-বিধানের সন্ধান লাভ করে, তখন হইতেই সুখ ও শান্তির পথে দেশ এবং জাতি গঠিত হইতে থাকে। তাই মানুষকে প্রথমে সব কিছুর মূলের দিকে এবং সামঞ্জস্যমন্ডিত সকল বিধান প্রতিবিধানের প্রতি নজর  দিতে হইবে।

সবাই বলে ‘আমি যদি ক্ষমতায় যাই তবে ইহার চাইতে ভাল করিব’। কিন্তু, ইংরেজ তাড়াইয়া মানুষ সুখে আছে বলে নাই। পাঞ্জাবী হটাইয়া সুখ তো দূরের কথা দুখের পর দুখ আসিতেছে। যে পার্টি বলিত ‘আমরাই ভাল করিবার পাত্র’, তাহাদিগকে পাইয়া মানুষ বুঝিয়াছে ‘আমি’ এবং ‘আমাদের’ দাবীদার হইলেই মানুষের সুখ শান্তি ফিরাইয়া আনিবার উপযুক্ততা থাকে না।  ...

মানুষের সেবা তথা সৃষ্টি মাত্রেরই কল্যাণ করিতে ‘আমি’ এবং ‘আমরা’ বলিবার কোন অবকাশ নাই। .. ‘আমরা’ এবং ‘আমাদের’ কল্যাণ করিব কি জন্য? উদ্দেশ্য কি থাকিবে?
উদ্দেশ্য থাকিবে ‘হক্কুল এবাদ’ কায়েম। ‘হক্কুল্লাহ’ আদায় না হইলে খালেস নিয়তে তওবা করিলে আল্লাহ মাফ করিয়া  দেন। কিন্তু ‘হক্কুল এবাদ’-এর  খেলাফ হইলে আল্লাহ মাফ দেন না।

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্ব শাসন  দেওয়া ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের ‘হক্কুল এবাদ’ আদায়ের নামান্তর। কেন্দ্র তাহা করে নাই; আল্লাহর বিধানও তাহা চিরকালের জন্য বরদাশত করে নাই

জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কোন দেশের প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষাগত, ধর্মীয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে বান্দার হক বুঝাইয়া দেওয়াই হইল ‘হুকুমতে রব্বানীয়া’-র প্রথম শর্ত। তজ্জন্য সামাজিক সাম্য, অর্থনৈতিক প্রয়োজনভিত্তিক বন্টন, তামাদ্দুনিক উৎকর্ষতা ইত্যাদী অপরিহার্য। মোট কথা, সকল ক্ষেত্রে বান্দার স্বাভাবিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক বুঝাইয়া দাও, তাহার অধিকারের আমানত বিন্দুমাত্র খেয়ানত করিও না। ...

আজ বাংলাদেশের অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে, তাহারা ‘হুকুমতে রব্বানিয়া’-কে ‘হনুজ দূর আস্ত’ মনে করে। ... তবে হতাশ হইবার কিছু নাই। আমাদের কাছে ‘রবুবিয়াত’-এর আদর্শ আমানত স্বরূপ রহিয়াছে। উহার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠাই সমস্যার সমাধান করিয়া দিবে, ইনশাল্লাহ। ...

[বইয়ের নাম “রবুবিয়াত – মওলানা ভাসানীর শেষ কথা”। সংকলক – সৈয়দ ইরফানুল বারী। প্রথম প্রকাশ অক্টোবর ২০০২। পরিবেশক – খন্দকার প্রকাশনী, জাতীয় সাহিত্য সৃজনী সংস্থা, এতিম খানা রোড, টাংগাইল।]

Sunday, February 19, 2012

কাতেবে অহী ও সাহাবী নবী করীম (সঃ)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর ইন্তেকালের পরে মুরতাদ হওয়া প্রসংগে হাদীস


নবী করীম (দঃ)-এর জীবদ্দশায় একজন কাতেবে অহী সাহাবী মুরতাদ হয়ে যায়ঃ-
সহিহ আল বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীছ নং-৩৩৪৯।
আনাস (রাঃ) বলেন, একজন লোক প্রথমে খৃষ্টান ছিল। পরে সে ইসলাম গ্রহন করে সুরা আল-বাকারা ও সুরা আলে-ইমরান পড়ে শেষ করল এবং নবী (সঃ) এর নির্দেশক্রমে (অহী) লিখতে শুরু করল (অর্থাৎ অহী লেখক নিযুক্ত হল)। তারপর সে [নবী (সঃ)-এর নিকট থেকে পালিয়ে  গিয়ে] আবার খৃষ্টান হয়ে গেল এবং বলতে লাগল, "আমি মুহাম্মদকে যা লিখে দিতাম তা ছাড়া আর কিছুই সে জানেনা"। তারপর আল্লাহ তাকে মৃত্যুমুখে পতিত করলে খৃষ্টানরা তাকে কবরস্থ করল। কিন্তু পরদিন সকাল বেলা দেখা গেল, ভূ-গর্ভ তাকে বাইরে ছুড়ে ফেলেছে।  তখন খৃষ্টানরা বলল, "এটা মুহাম্মদ ও তার সহচরদের কাজ। আমাদের এ লোকটি যেহেতু তার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিল তাই তারা এর কবর খুঁড়ে একে বাইরে ফেলে গিয়েছে।" অতঃপর তারা তার জন্য আরার কবর খুঁড়ল এবং যতটা সম্ভব তা গভীর করল। পরদিন সকালে আবার দেখা গেল যে, ভূ-গর্ভ তাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছে। এবারও খৃষ্টানরা বলল, "এটা মুহাম্মদ ও তার সহচরদের কাজ। আমাদের এ লোকটি যেহাতু তার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিল তাই তারা এর কবর খুঁড়ে একে বাইরে ফেলে গিয়েছে।"  অনন্তর তারা তার জন্য আবার কবর খুঁড়ল এবং যতদূর  সম্ভব কবরটি গভীর করল। কিন্তু পরদিন দেখা গেল যে ভূ-গর্ভ তাকে বাইরে নিক্ষেপ করেছে। তখন তারা বুঝতে পারল যে, এটা কোন মানুষের কান্ড নয়। তাই তারা তাকে ওভাবেই ফেলে রাখল।
-সহিহ আল বুখারী, ৩য় খন্ড, কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীছ নং-৩৩৪৯।
 
==০==
 
নবী করীম (দঃ)-এর ইন্তেকালের পর কিছু সাহাবী মুরতাদ হবে বলে ভবিষ্যদ্বানীঃ-
সহিহ আল বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীছ নং-৩১০১।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী (সঃ) বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদেরকে হাশর ময়দানে নগ্ন পা, উলংগ-দেহ এবং খতনা বিহীন অবস্থায় হাযির করা হবে। অতঃপর তিনি এই আয়াতটি তেলাওয়াত করলেনঃ "আমি প্রথমে যেভাবে সৃষ্টি করেছিলাম, সে ভাবেই পুনরায় সৃষ্টি করব। এটি আমার অটল  ওয়াদা, আমার উপর অপরিহার্য। আমি তা করবই।" আর কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাঁকে কাপড় পরান হবে তিনি হবেন ইবরাহীম (আঃ)। আর (সেদিন) আমার আসহাবগনের কয়েকজন লোককে পাকড়াও করে বাম দিকে নিয়ে  যাওয়া হবে। তখন আমি বলব, আমার আসহাব আমার আসহাব। এ সময় আল্লাহ তা'লা বলবেন, যখন আপনি তাদের থেকে চির বিদায় নেন, তখন এরা মুরতাদ হয়ে যায়। তখন আমি বলব, যেমন বলেছিলেন [আল্লাহর প্রিয় নেক বান্দাহ ঈসা (আঃ)] হে আল্লাহ আমি যতদিন তাদের মাঝে বর্তমান ছিলাম, ততদিন আমি তাদের অবস্থার পর্যবেক্ষণকারী ছিলাম। যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিলেন, তখন আপনিই ছিলেন তাদের অবস্থা প্রত্যক্ষকারী। আপনি তো সব কিছুর উপর প্রত্যক্ষদর্শী। যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, (তা দিতে পারেন) কেননা, এরা আপনা্রই গোলাম। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন, (তা ও করতে পারেন)। কারণ, আপনি মহা ক্ষমতাবান  এবং প্রজ্ঞার অধিকারী। 
-সহিহ আল বুখারী, ৩য় খন্ড, কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীছ নং-৩১০১।

Friday, February 3, 2012

হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলবী (রঃ) হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা কিতাবে লিখেছেনঃ


হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলবী (রঃ) হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা কিতাবে লিখেছেনঃ-

"জন্মগত স্বভাবের কারণে মানুষের মধ্যে পার্থক্য হয়"



"সমস্ত পয়গম্বর (:) একমত যে সকলের ধর্মই এক পার্থক্য শুধু শরীয়ত ধর্মের নিয়মাবলীতে"

"মযহাবে অভীজ্ঞজনের মযহাব সত্য"


"হুজুর (সাঃ) এরশাদ করিয়াছেন - আমাকে তোমাদের সহজতার জন্য প্রেরণ করা হইয়াছে, কঠোরতার জন্য নয়"



"আল্লাহতা'লা এরশাদ করিয়াছেন, হে বিশ্বাসী সম্প্রদায়, অনেক কিছু প্রার্থনা করিওনা যদি তোমাদের জন্য উহা উন্মুক্ত হইয়া যায় তখন তোমরা উহাকে অপছন্দ করিবে তাই প্রশ্নকারীদিগকে হুযুর (সাঃ) পছন্দ করিতেননা এবং বলিতেন - আমি তোমাদিগকে যাহা কিছু বলি তোমরা উহাকেই যথেষ্ট মনে কর, বেশী কিছু জিজ্ঞাসা করিওনা তোমাদের পূর্ব্ববর্তী উম্মতগণ এই কারণেই ধ্বংশ হইয়া গিয়াছে যে তাহারা বহু কিছু জিজ্ঞাসা করিত এবং নবীদের বিরোধিতা করিত তিনি আরও এরশাদ করিয়াছেন - মুসলমানদের মধ্যে ব্যক্তি পাপী যাহার প্রশ্ন করায় কোন কিছুকে হারাম করিয়া দেওয়া হয়"



"মোমেন বান্দা নরম শাখার ন্যায়"



 "বান্দার উপর আল্লাহর হক এবং ফরয এই যে বান্দা আল্লাহকে অসীম সন্মান করিবে"



"যে ধর্মের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে - তাহার সাথে  আল্লহও কঠোর ব্যাবহার করেন"



"শিষ্টতা শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইয়াতীমকে শাসন করা অন্যায় নহে; কিন্তু কষ্ট দেওয়ার ইয়াতিমকে আঘাত করা পাপ"



"ভুল করিয়া পাপ করিলে অনেক বিষয়ে ক্ষমা পাওয়া যায় এই ণীতি মোতাবেক মানুষের এলেম স্বভাব জাহের বাতেন থাকে - এই মোতাবেকই ব্যক্তির জন্য শরীয়ত নির্ধারিত হয়"


নবুয়ত প্রায়শঃ মিল্লাতের অনুজ্ঞ থাকে। যেমন আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করিয়াছেন – “তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের মিল্লাত”। আরও এরশাদ করিয়াছেন – “ইব্রাহীমও নূহের তরিকা ভুক্ত ছিলেন”। ইহার রহস্য এইযে বহুদিন পর্যন্ত লোক একটি মাযহাবের অনুসারী থাকে এবং সেই ধর্মের নির্দেশাবলীর সন্মান করিয়া থাকে। ফলে উহার কার্যাবলী এত প্রসিদ্ধ হইয়া যায় যে কোন মতেই উহা অস্বীকার করা যায় না। যখন সেই নবীর বাণী সমূহের মধ্যে লোকেরা পরিবর্তন পরিবর্ধন করিয়া ফেলে তখন অন্য একজন নবীর আবির্ভাবের সময় উপস্থিত হয় যেন  পূর্ববর্তি মাযহাবের দোষাবলী দূর হইয়া যায়। এই দ্বিতীয় নবুয়ত লোকজনের মধ্য হইতে প্রসিদ্ধ এবং সঠিক আহকামের অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানের পর যাহা সঠিক নির্দোষ মনে করেন দ্বিতীয় নবুয়ত উহা পরিবর্তন না করিয়া লোকেদের মধ্যে বলবৎ রাখেন এবং উহা  পালন করার জন্য নির্দেশ দেন। আর যাহার মধ্যে দোষ পাওয়া যায় উহার সংশোধণ করেন, যাহাতে কিছু সংযোগের প্রয়োজন হয় উহাতে সংযোগ করেন। প্রায়শঃ দ্বতীয় নবী ঐ সমস্ত কাজে যাহা প্রথম শরীয়তে বাকী থাকিয়া যায় নিজের উদ্দেশ্য  এবং দাবীর উপর গবেষণা করেন। তখন বলা হয় যে এই নবী অমুক নবীর মিল্লাত অথবা সম্প্রদায়ভুক্ত। অধিকাংশ সময় এই সমস্ত নবুয়ত মিল্লাতের বিভিন্নতার দরুণ বিভিন্ন প্রকারেরও হইয়া থাকে। মযহাবের একটি বিশেষরূপে অবতীর্ণ হওয়ায় দ্বিতীয় প্রকার এক অন্য প্রকারের পর্যায়ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা যদিও সময় ও কাল হইতে পবিত্র তথাপি কোন না কোন কারণে যুগ ও যুগের বস্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাই হুযুর (সাঃ) এরশাদ করিয়াছেন – প্রতি শতাব্দীর পর আল্লাহ তায়ালা বিরাট ঘটনা সমূহের মধ্যে কোন না কোন ঘটনা অবতীর্ণ করিয়া থাকেন। হযরত আদম (আঃ)  এবং অন্যান্য নবী (আঃ)-গণও শাফায়াতের হাদীসে এই  সম্বন্ধে কিছুটা এরশাদ করিয়াছেন – প্রত্যেক নবী কেয়ামতের দিন বলিবেন যে আল্লাহ তায়ালা আজ  যেমন ক্রোধান্বিত হইয়াছেন অন্য কোন দিন তেমন আর হন নাই এবং ভবিষ্যতে আর কোন দিন হইবেনও না।


"যখন পৃথিবী শরীয়ত গ্রহন করার জন্য প্রস্তুত হয় এবং ব্যাবস্থাপনা নির্ধারিত করার সময় হয়, তখন আল্লাহপাক তাজাল্লী প্রকাশ করিয়া মানুষের জন্য ধর্মকে গ্রহনযোগ্য করিয়া দেন সে অনুযায়ী মালায়ে আলা উন্নততর শক্তিতে শক্তিবান হইয়া যায়  তখন সামান্ন একটি কারণ আল্লাহর বকশীশের দ্বারে আঘাত করার জন্য যথেষ্ট হইয়া যায় সময়ে বীজ বপন করিলে অতি সহজেই ফসল পাওয়া যায় অসময়ে হাযার চেষ্টায়ও উহা পাওয়া যায় না"